গল্পঃ চলো পালাই
পর্বঃ তিন
লেখাঃ অধরা জেরিন
আমার ইচ্ছে করছিল ওই নীল কে মেরে আরো নীল বানাতে । কোনও কিছু না যেনেই এতো লাফালাফি । আমি ভিতরে বসে আছি । আলিফ আমাকে দেখে বললো তুমি কিছু মনে করো না। এরা আমাকে ভিষন ভালবাসে। ছোট বেলায় আমরা একই পাড়ায় থেকেছি। পরে আংকেল বদলি হয়ে এখানে চলে আসে। এর ভিতরে নীল এলো বললো কিরে দোস্ত আমাকে ও একটু জানাতে পারতিস তুই বিয়ে করেছিস ?
আলিফ বললো তুই সেই শুরু থেকেই বিয়ে বিয়ে করে আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছিস । আরে ও আমার বউ না। তারপর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কিছু বললো । নীল কিছু সময় বোকার মতো তাকিয়ে থেকে বললো ওহ তুই আগে বলবি তো !! আলিফ বললো তুই সেই সুযোগ দিলে তো বলবো । এখন বুদ্ধি দে কি করা যায় । আর আংকেল আন্টি কে সব বুঝিয়ে বল। নীল বললো আরে তুই কি খেপেছিস। সব কিছু বললে বাবা এখন ই তোর বাবা আর অধরার বাবা কে জানিয়ে দেবে যে তোরা এখানে এসেছিস। কারণ বাবা এই সব একদম পছন্দ করে না। আলিফ বললো তাহলে এখন উপায় ??নীল বললো শোন এখন এভাবেই চালিয়ে দে। ওদিকের সব ঠান্ডা হলে তোরা ফিরে যাস। আর এর ভিতরে অধরার হারানো জিনিস ফিরে পেলে কোনও সমস্যা হবে না । ও চলে যাবে ওর বন্ধুর কাছে । এই বলে আমার দিকে তাকিয়ে বললো আসলে আমি সরি। বুঝতে পারিনি । আপনার এখানে কোনও সমস্যা হবে না । আমার একটা ছোট বোন আছে । আপনি ওর সাথেই থাকতে পারবেন । আমি কিছু না বলে একটু হেসে দিলাম । আহারে বেচারা একটু ভুল করেছে। এর জন্যও তো আর মুখ ফুলিয়ে বসে থাকা যায় না ।
এর ভিতরে নীলের মা আর ছোট বোন টা এলো। ওর মা নীল কে উদ্দেশ্য করে বললো নীল তোর মাথায় কোনও বুদ্ধি আছে । ওরা সেই কতো দুর থেকে এসেছে । একটু রেস্ট নিবে তা নয় তুই এসে বকবক করছিস। তারপর আমাদের বললো চলো নাসতা করবা। নাসতার কথা শুনে মনে হচ্ছে কতো দিন কিছু খাওয়া হয়নি। খুব খিদে পেয়ে গেল আবার । নীল ওর ছোট বোনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। নীলা মেয়ে টার নাম । এবার নাইন এ পড়ছে । ওর সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভাল লাগলো। একটা সঙ্গী পাওয়া গেল ।
আমরা এক সাথে সবাই মিলে খাচ্ছি । এর ভিতরে নীলের বাবা বললো তোমাদের বিয়ে হয়েছে কতো দিন । এবার আলিফ আমার দিকে তাকিয়ে পড়লো। আমি কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। আলিফ এবার বললো এই তো কিছু দিন আগে । কথা টা শুনেই আমার ভিষন রাগ হলো । কিন্তু কি করার । এরকম অভিনয় কিছু দিন চালিয়ে যেতে হবে ।
আমি রুমে এসে বসে আছি । আলিফ এসে বললো অধরা তুমি রাগ করো না প্লিজ । এখানে আমাদের নিরাপদে থাকতে গেলে এই টুকু কষ্ট করতে হবে । না হলে নীলের বাবা সব কিছু জানিয়ে দেবে। আমি বললাম ঠিক আছে । তুমি আমার হারিয়ে যাওয়ার জিনিসের খোঁজ করো। আমার এক কাপড়ে থাকতে ভিষন বিরক্ত লাগছে । আলিফ বললো আচ্ছা ঠিক আছে আমি নীল কে বলে দেখি কি করা যায় । এই বলে নীল কে নিয়ে আলিফ চলে গেল ।
আমি আর নীলা বসে বসে গল্প করছি। নীলা আমাকে বললো আচ্ছা ভাবি !! আপনাদের কি লাভ ম্যারেজ ??
ওর মুখে ভাবি ডাকটা শুনে একটু চমকে গেলাম । কি বলবো এখন ওকে ?
আমি কিছু না বলে বললাম এটা তোমার আলিফ ভাইয়ার কাছে শুনে নিও। এর ভিতরে নীলের মা এসে বললো একি নীলা তুই এখনও এখানে বসে আছিস । যা গোসল করে নে। তারপর আমাকে বললো বউ মা তুমি ও গোসল করে নেও ভাল লাগবে । ওনার মুখে বউমা ডাক শুনে ভিষন লজ্জা লাগছিল । আমি বললাম আন্টি আপনি আমাকে নাম ধরেই ডাকবেন । আমার নাম অধরা । আন্টি খুশি হয়ে বললো আচ্ছা ঠিক আছে বলবো। যখন আমার খুশি হবে তখন । এখন যাও তুমি গোসল করে নেও। আমি এবার বললাম আসলে আন্টি আসার পথে আমার সব কিছু চুরি হয়ে গেছে । আন্টি আমার কথা শুনে বললো কি বলো তুমি সব চুরি হয়ে গেছে ?? আগে বলবে তো । এই বলেই চিৎকার করে বললো ওগো শুনছো ?? আমি ওনার চিৎকার শুনে একটু অবাক হয়ে গেলাম এতো চিৎকার করার কি হলো। আন্টির চিৎকার শুনে আংকেল বেরিয়ে এসে বললেন কি হয়েছে কি ?? আন্টি এবার বললেন আসার পথে মেয়ে টার সব কিছু গাড়ি থেকে চুরি হয়ে গেছে । আংকেল যেন আরো বেশি অবাক হয়ে গেলেন । তারপর বললেন কি ভাবে হলো ?? আমি বললাম বাইরে খাবার কিনতে গিয়েছিলাম এই সময় এসে দেখি কিছু নেই। তিনি আলিফের উপরে ভিষন রেগে গেলেন । বললেন ছেলে টার মাথায় কোনও বুদ্ধি নেই । মেয়ে টাকে পাঠিয়েছে খাবার কিনতে আর ও কি করছিল পরে পরে ঘুমাচছিল। আসুক আলিফ মজা দেখাচ্ছি ।
আমার খুব হাসি পাচ্ছিল সবার কান্ড দেখে । কিন্তু কেমন জানি পরিবার টাকে খুব ভাল লাগতে শুরু করলো। একটু পর আন্টি আমাকে একটা শাড়ি এনে দিয়ে বললো নাও এটা তুমি গোসল করে পরো। আমি শাড়ি দেখে বললাম আন্টি আমি শাড়ি পড়তে পারি না। আন্টি হেসে দিয়ে বললো আচ্ছা ঠিক আছে আমি পড়িয়ে দিচ্ছি ।
আমার শাড়ি পরা মাত্র শেষ হয়েছে এর ভিতরে আলিফ এসে হাজির । ও আমাকে শাড়ি পরা দেখা হা করে তাকিয়ে আছে । আমি ওর চোখে মুখে অন্য রকম ভাল লাগা দেখতে পেলাম । কিন্তু আমার ভিষন লজ্জা করছিল আমি ওকে বললাম আপনার সমস্যা কি ?? আগে কখনও এমন করে কাউকে দেখেননি ?? ও কিছু টা লজ্জা পেয়ে বললো আসলে তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে । আমি ওকে বললাম আমি জানি আমাকে কেমন লাগছে । এখন বলুন আমার হারিয়ে যাওয়া জিনিস গুলির খোঁজ পেলেন । আলিফ বললো আমি থানায় বলে এসেছি তিন চার পর সব খুঁজে বের করে দেবে। আমি বললাম ওহ ভাল । তাঁর পর আমি রিতার কাছে চলে যাব। আলিফ আমার কথা শুনে কিছুটা মন খারাপ করে বললো হুম জাবেই তো । আচ্ছা অধরা একটা কথা বলবো ? আমি হেসে দিয়ে বললাম কি কথা বলো ?? ও বাইরের দিকে তাকিয়ে উদাস চোখে বললো আমার কথা তোমার মনে পড়বে কখনও ??? আমি ওর কথা টা শুনে বললাম তোমার কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে । তুমি না থাকলে আমার যে কি হতো !!! আলিফ বললো আমি ও তোমাকে কখনও ভুলবো না। এর ভিতরে নীল এসে হাজির । হেসে দিয়ে বললো ঠিক বলেছিস এই রকম একটা মিষ্টি মেয়ে কে ভুলে যাওয়া ঠিক না। চল মা খেতে ডাকছে । অধরা তুমি ও চলো। নীলের কথা শুনে আমরা দু জনেই একটু লজ্জা পেলাম ।
আমরা সবাই এক সাথে খেতে বসেছি। এমন সময় আন্টি বললো কিরে আলিফ গাড়িতে আসার সময় বউমা সব কিছু হারিয়েছে তুই তখন কি করছিল ? আলিফ কথা টা শুনে খাওয়া বাদ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমি মিটমিট করে হাসছি। ও সব কিছু বুঝতে পেরে বললো ইয়ে না মানে আন্টি ভুল টা আমার ছিল । সমস্যা নেই আমি আর নীল থানায় জানিয়ে এসেছি। তাঁরা খুব শীঘ্রই ফেরত দেবেন ।
বিকেলে আমি আলিফ নীল এই তিন জন ঘুরতে বের হলাম । নীল আমাদের সব জায়গা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে । সিলেট খুব সুন্দর জায়গা । চারিদিকে সবুজ চা বাগান। দেখতে খুব সুন্দর । চোখ ফিরানো যায়না।
আলিফ আমাকে বললো অধরা তোমার কি কিছু লাগবে । সব কিছু তো চোর বাবাজির কাছে । আমি আলিফ কে বললাম আপাতত অল্প কিছু টুকটাক জিনিস হলেই হবে । আমরা তিন জন মার্কেটে গেলাম । আমার কিছু টুকটাক জিনিস কিনলাম । তারপর ফিরে চলে এলাম।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর আমাদের ঘুমাতে দেওয়া হলো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে থাকা নিয়ে । নীল বললো বাবা মা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর অধরা নীলার কাছে গিয়ে ঘুমাবে। অবশ্য নীলাকে সব কিছু খুলেই বলেছিল নীল। তাই করা হলো । সবাই ঘুমালে আমি চলে গেলাম নীলার কাছে ।
সকালে ঘুম থেকে উঠবার পর নাসতা সেরে নিলাম । একটু পর নীলা এসে আমাকে বললো অধরা আপু এইটা তোমাকে আলিফ ভাইয়া দিয়েছে। আমি খুলে দেখি দুইটা শাড়ি । আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। ও আমাকে শাড়ি দিয়েছে । আচ্ছা আলিফ ও কি আমাকে নিয়ে ভাবে । আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। নাকি আমি একা একা ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছি ।
দেখতে দেখতে তিন চার দিন হয়ে গেল । এই অল্প সময়ে আমি আলিফের অনেক কাছে চলে গেছি। কিন্তু কেউ কাউকে বলিনি। আমি ওর চোখে মুখে সেই ভাললাগা দেখতে পাই যেইটা একজন কে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায় নিশ্চিত মনে । আমরা কেউ কাউকে বলছি না কিন্তু দুইজন খুব বুঝতে পারছি একজন কে ছেড়ে অন্য জনের থাকা অসম্ভব ।
একদিন আলিফ এসে বললো অধরা তোমার হারানো সব জিনিস পাওয়া গেছে । অন্য কেউ হলে খুব খুশি হতো । কথা টা শুনে আমার একটু ও খুশি লাগছে না। কারণ আমার চলে যেতে হবে । আমি ওকে কিছু না বলে চলে গেলাম । আলিফ আমার কাছে গিয়ে বললো অধরা তুমি খুশি হওনি সব ফিরে পাওয়াতে। আমি একটু হেসে দিয়ে বললাম হুম হয়েছি।
আমি ফোন টা নিয়ে আগে বাড়িতে ফোন দিয়ে সব কিছু খুলে বললাম । ছোট চাচা বাবা মা সবাই চিন্তায় অস্থির ছিল । আমি ফোন করা তে সবাই বললো তুমি খুলনা ফিরে আসো । আর কোনও কথা তোমার শুনতে চাইনা। আমি বললাম কিন্তু ছোট চাচা,,,,,,??????ছোট চাচা বললো অধরা যা বলছি সেই টা করো । তুমি আজই খুলনা চলে আসবে ।
আমি আলিফ কে সব কিছু খুলে বললাম । ও কোনও কিছু না বলে মাথা টা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। আমি ওকে বললাম আলিফ কিছু বলো ?? আমার জন্য টিকিট কেটে আনো আমার আর থাকা সম্ভব না।
,,এই তিন দিন হলো আমি ফিরে এসেছি। সবার জন্য খুব খারাপ লাগছিল । বিশেষ করে নীলার জন্য । এই অল্প সময়ে মেয়ে টা অনেক আপন করে নিয়েছিলাম । আলিফ ও ঢাকা ফিরে এসেছে । আমরা এক সাথেই ফিরেছি। সারা পথ আমরা চুপচাপ থেকেছি। আলিফ আমার সাথে একটা কথা বলেনি। আমি দেখেছি ওর দুই চোখ রক্তের মতো টকটকে লাল হয়েছিল। আমার ও কোনও কথা মুখ দিয়ে বের হয়নি। মনে হচ্ছিল কোনও কথা বললে হয়তো এখনই কেঁদে ফেলবো। আসার আগে নীলের মা বাবা কে সব কিছু খুলে বলেছিল নীল। তাঁরা কিছু সময় চুপ করে থেকে বললো কথা টা আমাদের আগে কেন বললে না তাহলে তোমাদের আরও কষ্ট কম হতো । তারপর আমার হাত টা ধরে বললো অধরা মা তুমি কিছু মনে করো না। তোমাকে কতো কিছু বলেছি। তুমি আবার আসবে সিলেট বেরাতে । আমার কেন জানি খুব কান্না পাচ্ছে আমি আন্টি কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলাম ।
অধরা !! কি ভাবছো ??
হঠাৎ করে চমকে উঠলাম । দেখলাম আলিফ আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমি একটু হেসে দিয়ে বললাম আন্টি আংকেল সবাই কতো ভাল তাইনা ?? আলিফ আস্তে আস্তে মাথা নাড়িয়ে বললো হুম। তারপর বললো একটা কথা বলবো ?? আমি ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম বলো কি বলবে ?? আলিফ আমার হাত টা ধরে বললো অধরা আমি তোমাকে অনেক ভালবেসে ফেলেছি অনেক বেশি ভাল । তোমাকে ছেড়ে থাকা অসম্ভব । আমি ওর মুখে এই কথা টার জন্য অপেক্ষা করছিলাম । কবে আলিফ বলবে তোমাকে ছেড়ে থাকা অসম্ভব । আমি ওর চোখে চোখ রেখে বললাম এই কথা টা বলতে এতো দেরি করলে ?? আমার কথা শুনে ও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে । আমি হেসে দিয়ে বললাম কি হলো কি দেখছো এমন করে । আমি তোমাকে ভালবাসি কিনা জানতে ইচ্ছে করছে না ?? ও বললো অবশ্যই ইচ্ছে করছে । আমি ওর কাঁধে মাথা রেখে বললাম আমি ও তোমাকে ভিষন ভালবাসি ভিষন ।
আলিফ আমার হাত টা শক্ত করে ধরে বললো বিয়ে যদি করতেই হয় তবে তোমাকে করবো । আমি আরো জোরে হেসে দিয়ে বললাম হুম বিয়ে যদি করতেই হয় তবে পালিয়ে করবো।