সংসার
পর্ব দুই
লেখা অধরা জেরিন
ফারাবী আমার সামনে বসে আছে। আমি কি ওকে বলতে চাই ও খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে শুনবার জন্য । একটা ঢোক গিলে ওকে বললাম,,
-- ছোট বেলা আমার একটা বড়ো ধরনের রোগ ধরা পরেছিলো তাতে করে আমার জীবনের অনেক মূল্যবান কিছু হারাতে হয়েছে।
ফারাবী একটু অবাক হলো আমার কথা শুনে। তারপর শুকনো গলায় বললো,,
-- আমি বুঝতে পারছি না। কি বলতে চান আপনি?
আমি এবার বসা থেকে উঠে দাড়ালাম। জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে আছি। আমাদের উঠানে বিশাল বরই গাছ। অনেক রকমের পাখি ডাকাডাকি করে সকাল বিকাল। তাঁর মধ্যে কিছুদিন হলো নতুন চড়ুই দম্পত্তি এসেছে। সাথে তিন টা ছানা। জারা সারা দিন ছানা তিনটি নিয়ে হইহই করে বেড়ায়।বেশ ভালোই লাগে পাখিদের ছোটাছুটি দেখতে।
ফারাবী আমার পিছনে বসে আছে আমি একদম ভুলে গেলাম। আসলে যে দিন আমি ও জানতে পেরেছিলাম আমার কপালে মাতৃত্বের স্বাদ নেই সে দিন থেকে এমন হওয়া শুরু হয়েছে। মাঝে মাঝে আমার মন হারিয়ে যায়।
ফারাবী আমায় চুপ করে থাকতে দেখে বললো,,
- আপনি কিছু বলতে চেয়েছিলেন।
ওর কথা শুনে বললাম,,
- দেখুন আমি কোন দিন মা হতে পারবো না। আমার সেই কপাল নেই।
--মানে?
-- মানে বললাম তো, আমার অপারেশন করে,,,,,,,,,,
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ফারাবী বললো,,
-- আমি আর কিছু শুনতে জানতে চাই না। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। আপনার অতিত বর্তমান ভবিষ্যৎ কে নয়।
-- দেখুন আপনি ভুল করছেন, আপনার বাবা মা নিশ্চয়ই চাইবে না তাদের বংশের প্রদীপ না আসুক।
আমার কথা শুনে ফারাবী হেসে দিয়ে বললো,,
-- আপনি তো দেখছি সেই আদিম যুগের মানুষের মতো কথা বলছেন। বংশ মর্যাদা সব কিছু আল্লাহর হাতে। আল্লাহ নিশ্চয়ই আগের থেকে সব কিছু ফয়সালা করে রেখেছেন।
--কিন্তু !!
--কোনো কিন্তু নয় ইরা। তোমাকে আমি বিয়ে করবো এটাই সব। আমি পারবো তোমাকে নিয়ে সারা জীবন কাটাতে। তুমি পারবে না?
-- কিন্তু আপনার বাবা মা?
--সেটা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি শুধু হ্যা বলো।
সে দিন ফারাবীর কথায় আমার মন ছুঁয়ে গেলো। একটা ভরসা পেলাম, মনে হলো আমি আমার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছি। যাকে নিয়ে নতুন করে ঘর বাধা যায়।
আমার আর ফারাবীর বিয়ে হয়ে গেলো ঠিক বিশ দিন পরেই। খুব সাদামাঠা ভাবে। বিয়ের আগের দিন জারার জোরাজোরিতে একটু হলুদ ছুঁইয়ে ছিলাম গায়ে। দুই হাতে মেহেদীর আল্পনা।
পরের দিন বিয়ে হলো। আমি যখন প্রথম শ্বশুর বাড়িতে পা রাখলাম আশেপাশের মানুষের ফিসফাস শব্দ আমার কানে আসতে লাগলো। কেউ কেউ বলছে,
,'' শেষ মেষ একটা অপয়া ঘরে আনলো পোলাডা।,,
আবার কেউ কেউ বলছে,,
এই মেয়ের মধ্যে কি এমন আছে যে জাইনা বুইঝা একটা এমন বউ আনতে হবে,,
সবার কথা আমার কানে আসছে। আর মনে হচ্ছে কেউ ধারালো ছুরি দিয়ে আমার কলিজা কেটে টুকরো টুকরো করছে।
ফারাবী কি পারবে এতো গুলো মুখ বন্ধ করতে??
আমি বাসর ঘরে বসে আছি।
পাশের ঘর থেকে ফারাবীর কথার আওয়াজ কানে এলো। ফারাবী বলছে,,,
-- মা, তোমাদের কতো বার বলবো ইরা কোনো দিন মা হতে পারবে না এটা জেনে ও আমার কোনো আপত্তি নেই। তবু কেন সবাই এটা নিয়ে সমালোচনা করছে।
কথা গুলো মা আর ছেলের মধ্যে চলছে। আমি আরেকটু শোনার জন্য নিজেকে তৈরি করলাম। বুঝতে পারছি কথা গুলো আমার সমস্যা নিয়ে। এবং এটা সবাই জানে।
ফারাবীর মা ওকে বললো,,,
--- দ্যাখ বাবা, তুই তো গ্রামের লোক জন চিনিস। ওরা কিছু পেলে উঠে পরে লাগে। তুই বাদ দে ওদের কথা। যা ঘরে যা বউমা একা বসে আছে।
ফারাবী মায়ের কথা শুনে বললো,,,
-- ঠিক আছে গ্রামের লোকজনের যদি কোনো খেয়ে দেয়ে কাজ না থাকে তাহলে আমি ইরা কে শহরে আমার কাছে নিয়ে চলে যাবো। দেখি তখন সবার এতো সমস্যা কিসে আসে।
-- ফারাবী তুই ও শুরু করলি। এবার ঘরে যা তো।
আমি এবার বুঝতে পারলাম ফারাবী আমাকে সত্যি অনেক বেশি ভালোবাসে। ওর প্রতি আমার ভালোবাসা বহুগুণে বেড়ে গেলো। একটা কৃতজ্ঞতা বোধ নিজের ভিতরে বাসা বাঁধলো। নিজের অজান্তে চোখ ভিজে গেলো। এমন সময় পিছন থেকে কেউ আমার গায়ে হাত দিতেই আমি চমকে উঠে পিছনে তাকাতে দেখলাম ফারাবী হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে। আমার চোখ ভেজা দেখে বললো,,,
-- বাবা মায়ের কথা মনে পরছে?
ওর কথা শুনে আরো কান্না পেলো। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। ও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,,
-- আমি ঠিক তো সব ঠিক। তোমাকে কোনো দিন কষ্ট পেতে দিবো না।
আমাদের বাসর রাত কেটে গেলো স্বপনের মতো। মনে হচ্ছিল রাতটা অনেক ছোট করে দিয়েছে উপর ওয়ালা। অনেক কথা বাকি থেকে গেলো।
দেখতে দেখতে কেটে গেলো বেশ কয়েকদিন। ফারাবীর বেশি ছুটি না থাকায় আমাকে নিয়ে চলে এলো ওর বাসায়। বেশ গোছানো পরিপাটি ওর বাসা। আমার ভিষণ পছন্দ হলো। আসার আগে জারা আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল। ওকে কথা দিয়ে এসেছি খুব শীঘ্রই ওকে নিয়ে আসবো ঢাকা আমার বাসায়।
আমার খুনসুটি সংসার বেশ চলতে লাগলো। মাঝে মাঝে মান -অভিমান আদর ভালোবাসা জড়িয়ে কেটে যেতে লাগলো এক একটা দিন। সব কিছুর পূর্ণতা থাকলে ও একটা অপূর্ণতা দিন শেষে ফারাবী কে ঘিরে ধরতো। সেটা আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারতাম। বুঝতে পারতাম ও কি চায়। ফারাবী খুব একটা গ্রাম এ আমাকে নিতে চাইতো না। কারণ ওর একটা ভয় কাজ করতো। যদি আমি কষ্ট পাই।
মাঝে মাঝে ওর মন খারাপ দেখলে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হতো। কেন এই অপূর্ণতা বিধাতা আমায় দিলো। একদিন আমি ফারাবীর কাছে গিয়ে বললাম,,
--বেশ কিছু দিন ধরে তোমাকে একটা কথা বলতে চাইছিলাম৷
ফারাবী অফিসর একটা কাজ করছিল। ওটা সরিয়ে রেখে আমাকে কাছে টেনে নিয়ে কপাল থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,,,
-- আচ্ছা ইরা সত্যি করে বলোতো তোমার কি হয়েছে?
ওর কথা শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। একটু হেসে দিয়ে বললাম,,,
-- আমার কিছু হয়নি। তোমাকে একটা কথা বলতে চাই?
-- আচ্ছা বলো কি হয়েছে?
নিজেকে একটু সামলিয়ে নিয়ে বললাম,,
-- তুমি আবার বিয়ে করো ফারাবী।
ফারাবী আমার কথা শুনে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,,
-- তোমার কি মাথা ঠিক আছে? কি বলছো পাগলের মতো?
-- আমি ঠিকই বলছি! আমি চাই তুমি বাবা ডাক শোন৷
-- তাহলে তো তোমাকে বিয়ে করার কোনো দরকার ছিল না। অন্য মেয়ে বিয়ে করে বাবা ডাক শুনতে পেতাম।
-- আমি জানি তুমি ছোট বাচ্চা অনেক পছন্দ করো। তুমি আবার বিয়ে করো৷ আমার এতে কোন আপত্তি নেই।
-- পাগলামির একটা সিমা আছে ইরা। তোমাকে নিয়ে আমি ভালো আছি।
-- কিন্তু আমার তোমার জন্য কষ্ট হয়। তুমি বিয়ে করো।
হঠাৎ করে ফারাবী আমার কথায় রেগে গেলো। আচমকা আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে বললো,,,
--- আমি বিয়ে করলে তুমি খুশি?
আমি ফারাবীর এমন বিহেব করায় চমকে গেলাম। ফারাবী আমাকে আবার বললো,,,